রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা খন্দকার আলী আসগর হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পান। নাজনীন নামের আইডি থেকে ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের প্রস্তাব দিলে রাজি হন তিনি। নাজনীনের দেওয়া লিঙ্কে ঢুকে ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে সেটির স্ক্রিনশট নির্দিষ্ট টেলিগ্রাম গ্রুপে আপলোড করেন। চমকে দিয়ে মুহূর্তে আসগরের বিকাশ নম্বরে যুক্ত হয় ১৫০ টাকা।
আগ্রহ বুঝতে পেরে মুনাফার লোভ দেখিয়ে অনলাইনে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন নাজনীন। প্রথম ধাপে বিকাশের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা পাঠান আসগর। টাস্ক গ্রুপ করা হয়– যত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি মুনাফা। নাজনীনের প্রলোভনে সাড়া দিয়ে পাঁচ দফায় পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৮০০ টাকা পাঠান আসগর। এর পর মুনাফাসহ টাকা তুলতে গেলে বলা হয়, অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ (ফ্রিজ); ছাড়াতে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা লাগবে।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একের পর এক ফাঁদ পেতে ১৫ দফায় বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ও বিকাশে আসগরের কাছ থেকে এক কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৫ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। পরে ভুক্তভোগী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বিস্তারিত উল্লেখ করে টাকা উদ্ধারে সহায়তা চান। গত ২১ মে লালবাগ থানায় মামলা করেন তিনি।
শুধু আলী আসগর নয়, সাইবার অপরাধ কিংবা প্রতারণার শিকার হয়ে গত তিন মাসে (জুন থেকে আগস্ট) এক হাজার ৮২ ব্যক্তি সিআইডিতে অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে চাকরি, ঋণ, বাসাভাড়া, পাসপোর্ট তৈরি, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, ফ্রিল্যান্সিং, ডলার কেনাবেচা, অনলাইনে বিনিয়োগ ও কেনাবেচা-সংক্রান্ত প্রতারণা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছেন ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাকাটায় ৪৫৭ জন। এর পর বেশি অভিযোগ করেছেন অনলাইন বিনিয়োগে টাকা খোয়ানো ৩২১ জন।
সিআইডির তথ্যে, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এক লাখ ৭৪ হাজার ৮৩০ জন সংস্থাটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ (Cyber Police Center, CID, Bangladesh Police) ও হটলাইনে (০১৩২০০১০১৪৬, ০১৩২০০১০১৪৭ ও ০১৩২০০১০১৪৮) অভিযোগ করেছেন। ফেসবুক পেজে এক লাখ ২৪ হাজার ৯২৩ এবং হটলাইনে অভিযোগ এসেছে ৪৯ হাজার ৯০৭টি।
ফেসবুক পেজে ২০২০ সালে ২৭ হাজার ৭৮৬, ২০২১ সালে ৩২ হাজার ২৪২, ২০২২ সালে ২৫ হাজার ৪৩৫, ২০২৩ সালে ১৯ হাজার ৬৬২, ২০২৪ সালে ১৪ হাজার ২১৬ ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৮২ জন অভিযোগ করেছেন। হটলাইনে ২০২০ সালে আট হাজার ৭৯২, ২০২১ সালে ১০ হাজার ৭০৫, ২০২২ সালে ৯ হাজার ৭৭, ২০২৩ সালে আট হাজার ৫৫০, ২০২৪ সালে সাত হাজার ৫৫৬ ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে পাঁচ হাজার ২২৭টি।
এসব অভিযোগের মধ্যে সাইবার পুলিশ সেন্টার তাৎক্ষণিকভাবে ৯০ হাজার ৫৭৪ জনের সমস্যা সমাধান করেছে। মামলা রুজু হয়ছে ৪০টি। আর দুই হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিআইডি।
সূত্র জানায়, অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হ্যাকিং, ক্লোন, ব্ল্যাকমেইল, হুমকি, এমএফএস প্রতারণা, অনলাইন প্রতারণা, অনলাইন জুয়া, অনলাইন হয়রানি, পর্নোগ্রাফি, ব্যাংক কার্ড ও হিসাব নম্বর-সংক্রান্ত ইত্যাদি।
সিআইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছে অনলাইনে। অনলাইনে বিনিয়োগের লোভ দেখিয়ে অনেককে সর্বস্বান্ত করেছে প্রতারক চক্র।
অনলাইনে ৬০০ টাকা কেজি ইলিশের বিজ্ঞাপন দেখে সিরাজগঞ্জের নাজমুল হক অগ্রিম এক হাজার টাকা পাঠিয়ে ১০ কেজি দিতে বলেন গত বছরের ৩০ অক্টোবর।
বাকি টাকা মাছ হাতে পেয়ে দেবেন। পরদিন অজ্ঞাত ব্যক্তি ফোন করেন জানান, মাছ পাবনায় আছে; টাকা না পাঠালে দেওয়া যাবে না। বিকাশে নাজমুল চার হাজার ৯৯৯ টাকা পাঠান। চক্রটি তাঁর কাছ থেকে নানাভাবে ফাঁদ পেতে মোট ৪৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর বিষয়টি বুঝতে পারেন নাজমুল। সম্প্রতি সিআইডির সাইবার সেন্টারে অভিযোগ করেছেন তিনি।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান সমকালকে বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ফেসবুক ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে প্রতারক চক্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়ামাত্র আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সহযোগিতা এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি।