বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই সিদ্ধান্ত কেবল কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আইন প্রণয়নে গুণমান এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বের দর্শনে বড় রূপান্তরের ইঙ্গিত। পাশাপাশি সময়োপযোগী এবং গভীর চিন্তার প্রতিফলন। এর সদস্য নির্বাচন যদি হয় প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে, তখন এটি নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রতিনিধিত্ব বহুল ও বহুমাত্রিক মতামতের প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখবে। উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা মানেই কেবল একটি অতিরিক্ত আইনসভা নয়, বরং এটি একটি বিকল্প চিন্তা ও পুনর্মূল্যায়নের অবকাশ সৃষ্টি করবে। এমন প্রেক্ষাপটে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে উচ্চকক্ষ থেকে আমাদের প্রত্যাশা কেমন হওয়া উচিত, সেই প্রশ্ন এখন সময়ের কেন্দ্রবিন্দুতে।
প্রথমত, আমরা চাই একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী কণ্ঠস্বর। নিম্নকক্ষে রাজনৈতিক শক্তি প্রায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে একমুখী হয়ে পড়ে। উচ্চকক্ষে আমরা প্রত্যাশা করি, এমন সদস্য থাকবেন যারা দলীয় আনুগত্যের বাইরে গিয়ে নীতি, যুক্তি এবং জনস্বার্থের ভিত্তিতে মত প্রকাশ করতে পারবেন। বিশেষ করে, যখন কোনো বিল নিম্নকক্ষ থেকে পাস হয় দ্রুতগতিতে বা রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের ভেতর দিয়ে, তখন উচ্চকক্ষের কাজ হবে সেই প্রস্তাবগুলো পুনর্বিবেচনা করা। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংবিধানিক প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা। দ্বিতীয়ত, এই কক্ষ হতে পারে সেই প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দেশের উপেক্ষিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে। পিআর পদ্ধতি সম্ভাবনা সৃষ্টি করে এমন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন বা আদিবাসী, নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি সংসদে প্রবেশ করতে পারবে, যারা সাধারণত প্রথম-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান না। ফলে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্র্য তৈরি হবে চিন্তায়, অভিজ্ঞতায় এবং আগ্রহ।
তৃতীয়ত, উচ্চকক্ষকে আমরা দেখতে চাই জবাবদিহির নতুন কাঠামো হিসেবে। উচ্চকক্ষ থাকলে নির্বাহী বিভাগ আরও সংযত হবে। এক্ষেত্রে আমরা চাই উচ্চকক্ষ হবে নৈতিক বিবেকের মতো যেখানে আলোচনার কেন্দ্র হবে যুক্তি, তথ্য ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। চতুর্থত, আমরা চাই উচ্চকক্ষ হবে নীতিনির্ধারণে গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন কেন্দ্র। নিম্নকক্ষে যেহেতু সরাসরি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তাদের কাজ মূলত মাটির মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করা। অথচ উচ্চকক্ষের সদস্যরা যখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন, তারা হবেন দলীয় বা নাগরিক সমাজের চিন্তাশীল অংশ। এখানে নীতিনির্ধারণ, কৌশল, পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিচার করার সক্ষমতা বেশি থাকবে। আমরা চাই, এই কক্ষ থেকেই আসুক জাতীয় শিক্ষানীতি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার বা প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের মতো বিষয়ভিত্তিক গভীর চিন্তার সূচনা। প্রত্যাশার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে উচ্চকক্ষ কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তার ওপর। যদি দলীয় আনুগত্যের পুনরাবৃত্তি হয়ে দাঁড়ায়, অথবা নিছক পুঁথিগত আলোচনা আর বিতর্কের মঞ্চ হয় তবে তা সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে না। আমাদের প্রত্যাশা হলো, এই কক্ষ হবে মতবিনিময়ের কেন্দ্র, যেখানে ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু থাকবে জাতিগত মঙ্গলসাধনের অভিন্ন দায়বদ্ধতা।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে এককক্ষীয় সংসদ গৃহীত হলেও সে সময় কিছু বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা তখন বাস্তবায়িত হয়নি। একক কাঠামোতে অনেক সময় জনমতের বিচিত্রতা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা পর্যাপ্তভাবে প্রতিফলিত হয় না। বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই উচ্চকক্ষ একটি ভারসাম্য ও গঠনমূলক পর্যালোচনার কক্ষ হিসেবে কাজ করে। যেমনযুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস, যা আইন পাসে বিলম্ব ঘটিয়ে নয়, বরং পুনরায় চিন্তার সুযোগ এনে দেয়। আবার ভারতের রাজ্যসভা, যেখানে রাজ্যগুলোর কণ্ঠস্বর সংসদীয় সিদ্ধান্তে অন্তর্ভুক্ত হয়, তা কেন্দ্রীয় শাসনে এক ভারসাম্য রক্ষা করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট একটি শক্তিশালী উচ্চকক্ষ হিসেবে শুধু আইনই নয়, বিদেশনীতি, নিয়োগ এবং অভিশংসনের মতো বিষয়ের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ এ ধরনের আন্তর্জাতিক মডেলের আলোকে একটি কার্যকর, বিশ্লেষণভিত্তিক এবং দায়িত্বশীল কক্ষ হতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উচ্চকক্ষ কেবল সংসদীয় বিতর্কের বিকল্প নয়, এটি হতে পারে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার ইনকিউবেটর। অনেক সময় নিম্নকক্ষে নির্বাচনভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দলীয় চাপের কারণে যেসব প্রতিনিধি গভীর চিন্তা বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারেন না, উচ্চকক্ষে তাদের জন্য এমন একটি পরিসর তৈরি হবে যেখানে পরিণত চিন্তার জায়গা থাকবে। এখান থেকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক, নীতি প্রণেতা এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ তৈরি হতে পারে, যেটি আমাদের রাজনীতির পরবর্তী প্রজন্মকে আরও পরিণত ও দায়িত্বশীল করে তুলবে। সবশেষে, এই উচ্চকক্ষকে কেন্দ্র করে আমরা চাই গণতন্ত্রে নতুন আস্থা ফিরে আসুক। অনেক সময় রাজনীতিকে দলবাজি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর বিভাজনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু উচ্চকক্ষ যদি সত্যিকার অর্থে দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে বৈচিত্র্য, যুক্তি এবং ন্যায়নীতির প্রতিনিধিত্ব করে তবে এটি হতে পারে গণতন্ত্রে পুনরায় মানুষের আস্থা স্থাপনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। উচ্চকক্ষের মর্যাদা রক্ষা করা মানে শুধু আরেকটি কক্ষ চালু করা নয়, বরং গণতন্ত্রের মানোন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আমরা চাই, এই উচ্চকক্ষ হোক যুক্তিনির্ভর পর্যালোচনার জায়গা, যেখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে আলোচনায় আসবে নীতির গঠনমূলক গভীরতা। এটি হবে এমন একটি কণ্ঠমঞ্চ, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী, সংখ্যালঘু, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব বাস্তবায়ন পাবে। আমরা চাই এটি নির্বাহী ক্ষমতার ওপর একটি দায়িত্বশীল নজরদারির কাঠামো তৈরি করুক, নীতিনির্ধারণে যুক্তিসম্মত প্রশ্ন তুলুক এবং ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তায় দূরদর্শী অবদান রাখুক। সংক্ষেপে, এই উচ্চকক্ষ হোক জবাবদিহিমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও চিন্তাশীল গণতন্ত্রের একটি দৃঢ় স্তম্ভ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
শাহেদ শফিক, লন্ডন থেকে